ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও কোরবানি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

রেজাউল করীম রেজাউল করীম

ইসলামি সংগীত শিল্পী

প্রকাশিত: ৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২১ 482 views
শেয়ার করুন

 

ঈদুল আয্হা অর্থ কোরবানির ঈদ। কোরবানির শব্দমূল কুর্ব শব্দের অর্থ নৈকট্য, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে যা কিছু কোরবান বা উত্সর্গ করা হয় সেটাই কোরবানি। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন: আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি (সূরা হজ্জ: আয়াত ৩৪)। বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কোরবানির ঘটনা ঘটে একজন নারী পাওয়াকে কেন্দ্র করে।

 

 

হযরত আদম আলায়হিস্ সালামের বিবি হযরত হাওয়া ‘আলায়হাস সালামের গর্ভে প্রতিবছর এক পুত্র ও এক কন্যা জন্ম গ্রহণ করতেন। তখন এক যমজের পুত্রের সঙ্গে অন্য যমজের কন্যার বিয়ে দেবার রীতি ছিলো। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম তাঁর পুত্র হাবীলকে অন্য এক পুত্র কাবিলের যমজ বোন আকলিমার সঙ্গে রীতি অনুযায়ী বিয়ে দিতে চাইলে কাবিল বেঁকে বসলেন, তিনি নিজ যমজ বোনকে বিয়ে করতে চাইলেন। তখন হযরত আদম (আ) দুই পুত্রকেই কোরবানি দিতে বললেন এই বলে যে, যার কোরবানি আল্লাহ কবুল করবেন তার সঙ্গে আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।

 

তখন হাবীল পাহাড়ের উপর একটি দুম্বা রেখে দিলেন কোরবানির নিয়তে আর কাবিল রাখলেন কিছু শস্য। আকাশ থেকে বজ্রপাত হয়ে হাবীলের রেখে আসা দুম্বা ভস্মীভূত হলো। এতে বোঝা গেলো আল্লাহ হাবীলের কোরবানি কবুল করেছেন। তখন কাবিল ক্রোধে তার বিশ বছর বয়স্ক ভাইকে পাথর মেরে হত্যা করলেন। এটাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে শোনাও। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিলো, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না (সূরা মায়িদা: আয়াত ৫)।

 

 

ঈদুল আজহার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম ‘আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নিজের পুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামের কোরবানির ঘটনা স্মারক হিসেবে। কুরআন মজীদে সেই কোরবানির ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে (সূরা আস-সাফ্ফাত: আয়াত ১০১-১০৮)।

 

হযরত ইব্রাহীম ‘আলায়হিস্ সালাম পুত্রের বদলে একটা দুম্বা কোরবানি দিয়েছিলেন। আর সেই কোরবানির চেতনা ধারণ করে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালিত হয়ে আসছে সেই তখন থেকেই। এই কোরবানি হজ অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ৯ জিলহজ্ব আরাফাত ময়দানে হাজীগণ সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করে সূর্যাস্তের পরপরই তিন মাইল পূর্বদিকে অবস্থিত মুযদালিফায় এসে অবস্থান করেন এবং সকালে এখান থেকে তিন মাইল পূর্বদিকে অবস্থিত মিনাতে এসে পশু কোরবানি দেন এবং ইহ্রাম মুক্ত হন।

 

এই ১০ জিলহজ্বকে বলা হয় ইয়াওমুন্ নহর। সারা মুসলিম দুনিয়ায় এই দিন পালিত হয় ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। এই কোরবানির উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং তাকওয়া অর্জন করা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: আল্লাহর নিকট পৌঁছে না ওগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশ্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সূরা হজ: আয়াত ৩৭)।

কোরবানি কি?

রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা আজহার দিনকে এ উম্মতের জন্য মনোনীত করে এতে ঈদ প্রবর্তনের জন্য আমাকে আদেশ করছেন।’ যে বিষয়গুলো ঈদুল আজহাকে স্বার্থক ও আলোকোজ্জ্বল করেছে তার মধ্যে কোরবানি অন্যতম বিধান।

কোরবানি এটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলঃ

১. নৈকট্য অর্জন করা

২. কাছে আসা

৩. পুন্য

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, যে কাজের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করা যায় তাকে কোরবানি বলা হয়। কোরবানির অপর নাম হলঃ اُضْحِيَّة যার অর্থ হলঃ

১. জবাই করা

২. উৎসর্গ করা

৩. শিকার করা

৪. পাকড়াও করা

৫. নৈকট্য অর্জন করা

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে,নির্দিষ্ট পন্থায়,নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে اُضْحِيَّة বলে। (ফাতওয়ায়ে শামি)

কোরবানি উম্মতে মুহাম্মদির জন্য কোনো বিশেষ প্রথা বা অভিনব হুকুম নয়। পুর্ববর্তি উম্মতদের উপরও ছিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।” [হাজ্জ,৩৪]

কোরবানির ইতিহাস

কোরবানির বিষয়টি মানব ইতিহাসের মতো অতি প্রাচীন। হজরত আদম আঃএর পুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরবানির সূচনা হয়। সে সময় কোরবানির নিয়ম ছিল অন্য রকম। ভেড়া, দুম্বা,শস্য বা গম ইত্যাদি কোরবানির জন্য আল্লাহর দরকারে পেশ করা হতো। যার কোরবানি কবুল হতো আল্লাহর হুকুমে আকাশ হতে আগুন এসে তা ভস্মীভূত করে দিতো। আর যারটা কবুল হতো না তারটা পড়ে থাকত। হজরত নূহ আঃ, হজরত ইয়াকুব আঃ, হজরত মূসা আঃ-এর সময়েও কোরবানির প্রচলন ছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির জনক হজরত ইব্রাহিম আঃ আল্লাহর প্রেমে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় সোনালি ইতিহাস সৃষ্টি করে গিয়েছেন।

হজরত ইব্রাহিম আঃ-এর প্রিয় বস্তু কোরবানিঃ

হজরত ইব্রাহিম আঃ স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দেয়ার জন্য আদিষ্ট হন। এ জন্য তিনি তিন দিনে শত শত উট কোরবানি করলেন কিন্তু তা আল্লাহর দরবারে কবুল হলো না। বারবারই স্বপ্নযোগে আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয়বস্তু কোরবানি করো।’ হজরত ইব্রাহিম আঃ বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান এবং হজরত হাজেরার নির্বাসিত হয়ে বহু কষ্টে লালিত নয়নের মণি হজরত ইসমাইল আঃ সেই প্রিয় বস্তু।আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে হজরত ইব্রাহিম আঃ ও মা হাজেরা কোরবানির জন্য কলিজার টুকরা পুত্রকে সাজিয়ে নিলেন। কিশোর ইসমাইল আঃ নিজের জানকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। পবিত্র কুরআনে ওই বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। ‘হজরত ইব্রাহিম আঃ বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে,আমি তোমাকে জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী? বলো। তিনি বললেন, আব্বাজান!

 

আপনি যে বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে আদিষ্ট হয়েছেন, তা পূর্ণ করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। যখন তারা উভয়ে আত্মসমর্পণ করলেন এবং পিতা কাত করে পুত্রকে শোয়ালেন, তখন আমি তাকে ডাকলাম, হে ইব্রাহিম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্য পরিণত করে দেখিয়েছেন। আমি বিশিষ্ট বান্দাদের এরূপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল বড় পরীক্ষা। আর ইসমাইল আঃ-এর পরিবর্তে একটি শ্রেষ্ঠ জবেহর পশু দান করলাম।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২ থেকে ১০৭)।

 

আল্লাহু আকবার তাকবিরঃ হজরত ইব্রাহিম আঃ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কলিজার টুকরা পুত্রের গলায় যখন ছুরি চালান, তখন হজরত জিব্রাইল আঃ আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে একটা দুম্বা নিয়ে রওনা হলেন। তাঁর মনে ভয় ছিল না জানি পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ইব্রাহিম আঃ জবেহ কাজ শেষ করে দেন! আর এ জন্যই জিব্রাইল আঃ আকাশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন ‘আল্লাহু আকবার’।এমন মধুর ধ্বনি শুনে হজরত ইব্রাহিম আঃ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন ।‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। হজরত ইসমাইল আঃ পিতার মুখে তাওহিদের বাণী শুনতে পেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ হজরত জিব্রাইল আঃ এবং দুই নবীর কালামগুলো আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত ঈদুল আজহার দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে ওই কালামগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে।

 

সুন্নতে ইব্রাহিমঃ আল্লাহর প্রেমিক হজরত ইব্রাহিম আঃ এর ধারালো ছুরি হজরত ইসমাইল আঃ-এর একটি পশমও কাটতে পারেনি। তার পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে জিব্রাইল আঃ বেহেশত থেকে জান্নাতি দুম্বা এনে দিলে তিনি তা কোরবানি করেন। হজরত ইব্রাহিম আঃ প্রাণ প্রিয় পুত্রকে কোরবানি দেয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর প্রেমের গভীরতা কত তাই প্রমাণ করেছেন। তাই অনন্তকাল ধরে কোরবানির এ মডেল সুন্নতে ইব্রাহিম হিসেবে বিশ্বের সব মুসলমানের কাছে আজ স্মরণীয়, বরণীয় এবং অবশ্য পালনীয় হয়ে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

 

সাহাবাদের কোরবানি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বলেছিলেন,¬ ‘সুন্নাতা আবিকুম ইবরাহিম’ অর্থাৎ এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম আঃ-এর প্রতিষ্ঠিত আদর্শ (ইবনে মাজাহ)।

 

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি মূলত মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একটি মহান পরীক্ষাস্বরূপ ছিল। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে,

 

إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلْبَلَـٰٓؤُا۟ ٱلْمُبِينُ

নিশ্চয়ই এটা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা’ (সূরা সাফফাত-আয়াত-১০৬)।

পবিত্র কুরআনের সূরা আস সাফফাত, ৯৯ থেকে ১১৩ নম্বর আয়াতে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। একান্ত প্রার্থনায় ৮৬ বছর বয়সে হজরত ইবরাহিম (আ. পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে লাভ করেন। তাফসিরে মাজহারির বর্ণনা মতে, হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর বয়স যখন ১৩ বছর (মাত্র বালেগ), তখন পিতা ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেন, তিনি প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল-কে (আ.) জবাই করছেন। (কোনো কোনো তাফসিরে বর্ণিত আছে¬, এ স্বপ্ন হজরত ইবরাহিমকে (আ.) তিনবার দেখানো হয়)। আম্বিয়া কেরামের স্বপ্ন যেহেতু ওহি হিসেবে গণ্য, তাই তিনি ৯৯ বছর বয়সে প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর সম্মতিক্রমে আল্লাহর আদেশ পালনার্থে প্রস্তুত হন। কিন্তু শয়তান পিতা-পুত্রের সে সাধনায় বাদ সাধে। মহামহিম আল্লহতায়ালার সে অগ্নিপরীক্ষায় পিতা ইবরাহিম (আ.) ও পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর আত্মত্যাগ যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, শয়তান সে লক্ষ্যে তিন তিনবার ধোঁকা দেয়। প্রতিবারেই পিতা-পুত্র পর্বতসম ঈমানী চেতনা নিয়ে সে চক্রান্ত প্রতিহত করেন। ২১টি প্রস্তর নিক্ষেপে শয়তানকে নিরাশ করে তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। (এ জন্যই হাজিরা মিনায় শয়তানকে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেন।) তাদের উভয়ের প্রতি আল্লাহ খুশি হয়ে পুত্র ইসমাঈলের পরিবর্তে ফেরেস্তাদের দ্বারা আনীত পশু কোরবানির ব্যবস্থা করেন।

উম্মতে মুহাম্মদির কোরবানি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর গোটা জীবন ছিল কোরবানি তথা অতুলনীয় আত্মোৎসর্গ ও আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল। প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করা ছিল ইবরাহিমি জীবনের অসংখ্য কোরবানির চরম ও শ্রেষ্ঠতম ঘটনা।

‘কোরবানি’ ও ‘ইসলাম’ উভয়‌ আনুগত্য, আত্মসমর্পণ, আত্মত্যাগ ও উৎসর্গীকরণের অর্থ বোঝায়। তাই পবিত্র কুরআনে ইবরাহিমি কোরবানির এ মহান আদর্শ ‘ইসলাম’ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশিত। এরশাদ হয়েছে :

إِذْ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسْلِمْ ۖ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ

অর্থাৎ তার প্রতিপালক যখন তাকে (ইবরাহিমকে) বলছিলেন আত্মসমর্পণ করো, তিনি বললেন, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম(সূরা বাকারাহ, আয়াত-১৩১)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে, ইবরাহিমি মিল্লাতের মৌলিক নীতি ও স্বরূপ ‘ইসলাম’ শব্দের মধ্যেই নিহিত। (মা’রেফুল কুরআন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান অনূদিত পৃষ্ঠা ৬৭) শুধু তাই নয়, হজরত ইবরাহিম (আ.)আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলেন¬

رَبَّنَا وَٱجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةًۭ مُّسْلِمَةًۭ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَآ ۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ

‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে (ইবরাহিম ও ইসমাঈল) মুসলিম (আনুগত্যশীল) করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একদলকে আনুগত্যকারী করো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৮)।

উম্মতে মুহাম্মদি তথা মুসলমান তারই দোয়ার ফসল। আগেই তিনি এ জাতির নাম মুসলমান রেখেছিলেন। এরশাদ হয়েছে,

مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَ‌ٰهِيمَ ۚ هُوَ سَمَّىٰكُمُ ٱلْمُسْلِمِينَ

এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ.-এর ধর্ম। তিনিই ইতঃপূর্বে তোমাদের ‘মুসলমান’ নামকরণ করেছেন এবং এতেও (কুরআনে) এ নাম রাখা হয়েছে (সূরা হজ, আয়াত-৭৮)।

ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনাদর্শে মুগ্ধ হয়ে মহান আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মদিকে তাঁর আদর্শের প্রতি দীক্ষিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে,

قُلْ صَدَقَ ٱللَّهُ ۗ فَٱتَّبِعُوا۟ مِلَّةَ إِبْرَ‌ٰهِيمَ حَنِيفًۭا وَمَا كَانَ مِنَ ٱلْمُشْرِكِينَ

‘বলো আল্লাহ সত্য বলেছেন, অতঃপর একনিষ্ঠভাবে ইবরাহিমী মিল্লাত অনুসরণ করো’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত-৯৫।

সূরা মুমতাহিনায় এরশাদ হয়েছে ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য হজরত ইবরাহিমের মধ্যে উৎকৃষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে’ (আয়াত-৪)

কুরবানির হুকুম কি?

এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে দুটো মত রয়েছে।

প্রথম মত : কোরবানি ওয়াজিব।

ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন।

(এক) আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন :

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ

‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি কর।’ [কাওসার,২]

আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব হয়ে থাকে।

(দুই)

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا»

রাসূলে কারীম স. বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।[মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজা- ৩১২৩ হাদিসটি হাসান]

যারা কোরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্ক-বাণী। তাই কোরবানি ওয়াজিব।

(তিন) রাসূলে কারীম স. বলেছেন

: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيّة

: হে মানব সকল ! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কোরবানি দেয়া। [মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজা- ৩১২৫ হাদিসটি হাসান]

দ্বিতীয় মত : কোরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।

এটা অধিকাংশ উলামাদের মত। এবং ইমাম মালেক ও শাফেয়ী রহ.-এর প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন : সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কোরবানি পরিত্যাগ করা মাকরূহ।

যদি কোন জনপদের লোকেরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কোরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কোরবানি হল ইসলামের একটি মহান নিদর্শন।

যারা কোরবানি সুন্নত বলেন তাদের দলিল :

(এক) রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :

إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ وَعِنْدَهُ أُضْحِيَّةٌ يُرِيدُ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلَا يَأْخُذَنَّ شَعْرًا، وَلَا يَقْلِمَنَّ ظُفُرًا

‘তোমাদের মাঝে যে কোরবানি করতে চায়, যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কোরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে।[ মুসলিম- ১৯৭৭]

এ হাদিসে রাসূল স.-এর ‘যে কোরবানি করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝে আসে এটা ওয়াজিব নয়।

(দুই) রাসূল স. তার উম্মতের মাঝে যারা কোরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে কোরবানি ওয়াজিব নয়।

শাইখ ইবনে উসাইমীন রহ. উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন: এ সকল দলিল-প্রমাণ পরস্পর বিরোধী নয় বরং একটা অন্যটার সম্পূরক। সারকথা হল যারা কোরবানিকে ওয়াজিব বলেছেন তাদের প্রমাণাদি অধিকতর শক্তিশালী। আর ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত এটাই।

কাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব?

১. জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ কোরবানির দিনগুলোতে যাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত শরয়ি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকবে তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব।

নিসাবের পরিমাণ হলো, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা এ পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়া। কোরবানির নিসাবের ক্ষেত্রে সম্পদ এক বছর পর্যন্ত নিসাবের মালিকের কাছে থাকা জরুরি নয়। বর্তমান বিশ্ববাজারে রুপার মূল্য স্বর্ণের মূল্যের তুলনায় কম হওয়ায় নিসাবের ক্ষেত্রে রুপার মূল্যই গণ্য হবে। প্রত্যেক দেশে সেখানকার বাজারমূল্য ধর্তব্য হবে।

২. মুসাফিরের ওপর (সফরে থাকলে) কোরবানি করা ওয়াজিব হয় না।

৩. কোরবানি ওয়াজিব না হলেও নফল কোরবানি করলে কোরবানির সওয়াব পাওয়া যাবে।

৪. কোরবানি শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়, সন্তানাদি, বাবা-মা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না, তবে তাদের পক্ষ থেকে করলে তা নফল কোরবানি হবে।

৫. যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয় সে কোরবানির নিয়তে পশু কিনলে সেই পশু কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়।

৬. কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানির মানত করলে সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে গরিব হোক বা ধনী হোক তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

৭. যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব সে কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানি না করলে কোরবানির দিনগুলো চলে যাওয়ার পর একটা বকরির মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।

৮. মৃত ব্যক্তির নামেও কোরবানি হয়। মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা তিন ধরনের হতে পারে। যেমন- ক. নিজের কোরবানিতে পরিবারের মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদের নিয়তের মাধ্যমে শরিক করা বৈধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে এ ধরনের কোরবানি প্রমাণিত আছে। এভাবে দেয়া কোরবানির গোশত পরিবারের সবাই খেতে পারবে। খ. মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় তার পক্ষ থেকে কোরবানি করার অসিয়ত করে থাকলে অসিয়ত বাস্তবায়ন করার জন্য মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ আছে। গ. রাসুলুল্লাহ (সা.), তাঁর স্ত্রীদের ও বুজুর্গদের নামেও কোরবানি হতে পারে।

কোরবানির পশু জবেহ করার নিয়মাবলি

কোরবানি দাতা নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবেহ করবেন, যদি তিনি ভালভাবে জবেহ করতে পারেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. নিজে জবেহ করেছেন। আর জবেহ করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কোরবানি নিজে জবেহ করার চেষ্টা করা উচিত।

ইমাম বোখারি রহ. বলেছেন : সাহাবি আবু মুসা আশআরী রা. নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কোরবানির পশু জবেহ করেন। তার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয় মেয়েরা কোরবানির পশু জবেহ করতে পারেন। তবে কোরবানি পশু জবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েজ আছে। কেননা সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা. তেষট্টিটি কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ করে বাকিগুলো জবেহ করার দায়িত্ব আলী রা.-কে অর্পণ করেছেন।

 

জবেহ করার সময় যে সকল বিষয় লক্ষণীয়

(১)যা জবেহ করা হবে তার সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে, তাকে আরাম দিতে হবে। যাতে সে কষ্ট না পায় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। হাদিসে এসেছে, সাহাবি শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স. বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল বিষয়ে সকলের সাথে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবেহ করবে তখনও তা সুন্দরভাবে করবে। তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা জবেহ করা হবে তাকে যেন প্রশান্তি দেয়।

(২) যদি উট জবেহ করতে হয় তবে তা নহর করবে।নহর হল উটটি তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে আর সম্মুখের বাম পা বাধা থাকবে।তার বুকে ছুরি চালানো হবে।কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন: সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন : এর অর্থ হল তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাধা থাকবে।

উট ছাড়া অন্য জন্তু হলে তা তার বাম কাতে শোয়াবে।ডান হাত দিয়ে ছুরি চালাবে। বাম হাতে জন্তুর মাথা ধরে রাখবে। মোস্তাহাব হল জবেহকারী তার পা জন্তুটির ঘারে রাখবে। যেমন ইতিপূর্বে আনাস রা. বর্ণিত বোখারির হাদিসে আলোচনা করা হয়েছে।

(৩) জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : যার উপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর। জবেহ করার সময় তাকবীর বলা মোস্তাহাব। যেমন হাদিসে এসেছে:

জাবের রা. থেকে বর্ণিত … একটি দুম্বা আনা হল। রাসূলুল্লাহ স. নিজ হাতে জবেহ করলেন এবং বললেন বিসমিল্লাহ ওয়া আল্লাহু আকবর, হে আল্লাহ ! এটা আমার পক্ষ থেকে। এবং আমার উম্মতের মাঝে যারা কোরবানি করতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে। অন্য হাদিসে এসেছে

রাসূলুল্লাহ সা. দুটি শিংওয়ালা ভেড়া জবেহ করলেন, তখন বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর পাঠের পর—اللّهُمَّ هَذَا مِنْكَ وَلَكَ—(হে আল্লাহ এটা তোমার তরফ থেকে, তোমারই জন্য) বলা যেতে পারে। যার পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করা জায়েজ আছে। এ ভাবে বলা—‘হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও।’ যেমন হাদিসে এসেছে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কোরবানির দুম্বা জবেহ করার সময় বললেন :—

‘আল্লাহ নামে, হে আল্লাহ ! আপনি মোহাম্মদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন।’

কেমন হবে কোরবানির পশু?

পাশবিকতা দমন এবং ত্যাগের শিক্ষা, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য প্রিয়বস্তু ও প্রিয়প্রাণ উত্সর্গের মহোত্সব ‘কোরবানি’। উজুহিয়্যা, জাবাহা, হাদিঈ, ইহরাকিদ-দাম ইত্যাদি কোরবানির সমার্থক। আর শরি’আতের পরিভাষায় ‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে’ (শামি ৫ম খণ্ড)। প্রিয়নবী (স) বলেছেন, ‘সুন্নাতা আবিকুম্ ইব্রাহিম’ অর্থাত্ ‘এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের (আ) আদর্শ’ (মেশকাত)।

মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য কোরবানির পশুটিকে হতে হবে প্রিয় ও পছন্দনীয়। হেদায়া ৪র্থ খণ্ডে আছে ছয়টি বিশেষ পশু দ্বারা কোরবানি আদায় করতে হবে এবং এগুলোর মধ্যে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক বছর, গরু, মহিষ দু’বছর এবং উট পাঁচ বছরের কম হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। পশুগুলোও হতে হবে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত। হযরত মুসার (আ) যুগের একটি হত্যা রহস্য উন্মোচনে গরু কোরবানির বর্ণনার কারণে আল কোরআনের সর্ববৃহত্ সুরার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাকারা’ বা গরু। এ সুরার ৬৭-৭১ নম্বর আয়াতে ঐ গরুর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। যা কোরবানির পশু নির্বাচনের আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচ্য। যেমন- (ক) মধ্যম বয়সী হওয়া (খ) হলুদ উজ্জ্বল গাঢ় বর্ণের হওয়া (গ) আকর্ষণীয় ও দর্শকনন্দিত হওয়া (ঘ) পরিশ্রম ক্লান্ত না হওয়া (ঙ) সুস্থ ও নিখুঁত হওয়া। কোরবানির পশু মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও অনুপম সৃষ্টি নৈপুণ্যের নিদর্শন। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কারণে কোন কোন বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত এবং বিপুল উত্সাহে প্রতি বছর অসংখ্য উট, গরু ইত্যাদি কোরবানি হলেও এগুলো টিকে আছে আপন অস্তিত্বে। এজন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে “ কোরবানির উট-গরুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ বানিয়েছি” (হজ্ব: ৩৬)।

 

কোরবানির পশু হতে হবে দোষমুক্ত। কেননা প্রিয়নবীর (স) নির্দেশনা হলো- ‘ কোরবানির পশুতে চারটি দোষ সহনীয় নয়— (ক)স্পষ্টত অন্ধ (খ) মারাত্মক অসুস্থ (গ) দুর্বল-হাড্ডিসার (ঘ) চার পায়ে চলতে পারে না এমন অক্ষম বা খোঁড়া’(তিরমিযি)। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘‘ইবনু ওমর (রা) এমন পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন যার দাঁত নেই এবং যা সৃষ্টিগতভাবেই পঙ্গু”(মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ)। অন্যদিকে পশুগুলোর জন্মের পবিত্রতা নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। এজন্যই কৃত্রিম প্রজননের প্রাণী, বন্যপ্রাণী, চারণভূমিতে অবাধ বিচরণশীল প্রাণী কোরবানির ক্ষেত্রে পরিহার করা উচিত। এমনকি ফতোয়ায়ে শামি গ্রন্থে আছে, পবিত্র খাবার খায়িয়ে পশুগুলোর শরীর থেকে অপবিত্রতা দূর করবার জন্য এবং অপবিত্র খাবার থেকে মুক্ত রাখবার জন্য উট ৪০ দিন, গরু মহিষ ২০ দিন, ছাগল ভেড়া ১০ দিন বেঁধে রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।

 

ফিকহগ্রন্থে ত্রুটিমুক্ত পশুপ্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যাতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়—১. দু’চোখ বা এক চোখ এক তৃতীয়াংশের বেশি অন্ধ পশু কোরবানি চলবে না । ২. তিন পায়ে চলে বা চার পায়ে ভর দিতে পারে না এমন পশু কোরবানি করা বৈধ নয়। ৩.পশুর কান বা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশি কাটা থাকলে কোরবানি হবে না। ৪. মজ্জা শুকিয়ে গেছে এমন হাড্ডিসার পশুতে কোরবানি হবে না। ৫. শিং ্ওঠেইনি অথবা শিং অগ্রভাগ বা সামান্য ভাঙ্গা হলে চলবে তবে শিং যদি মূল থেকে ভেঙ্গে থাকে তাতেও কোরবানি শুদ্ধ হবে না। ৬. যে পশুর চামড়া, পশম নষ্ট বা চর্মরোগের কারণে গোশত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন পশু কোরবানি করা যাবে না। তবে গর্ভবতী পশু কোরবানি করা যায়, তা কোরবানি করা বৈধ। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের সময় অত্যাসন্ন এমন পশু কোরবানি করা মাকরূহ। কেননা, ইবাদত ত্রুটিমুক্ত হওয়া জরুরি। আর কোরবানি একটি উচ্চমর্যাদার ইবাদত। হাদিসের বিবরণে রয়েছে, কোরবানির পশু হাশরের ময়দানে শিং, কান, চোখ, লেজ ইত্যাদিসহ হাজির করা হবে।

 

আল্লাহ পাক আমাদের বিশ্বের সকল মুসলিম উম্মার কোরবানীকে যেনো কবুল করেন,আমিন।